বাংলাদেশ-ভারত উত্তেজনায় দুশ্চিন্তায় জাইকা ও এডিবি
বাংলাদেশ-ভারত কানেক্টিভিটি উন্নয়ন প্রকল্প: বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ
___________________________________________________________________
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কানেক্টিভিটি উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগ করেছে জাপানের জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) এবং এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক)। এ অর্থায়নের মাধ্যমে সড়ক, রেল এবং বন্দরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে এসব প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
জাইকা ও এডিবির বিনিয়োগ:
জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা ২০২৩ সালে এক বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় কানেক্টিভিটি উন্নয়ন জাপানের কৌশলগত অগ্রাধিকারের অংশ। গত এক দশকে জাইকা বাংলাদেশ এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ১০০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে ২০০ কোটির বেশি ব্যয় হয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতে।
অন্যদিকে, সাসেক (সাউথ এশিয়া সাবরিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন) উদ্যোগের আওতায় এডিবি ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশ এবং ভারতে এডিবির বিনিয়োগ যথাক্রমে প্রায় ৮ বিলিয়ন ও ৭.৫ বিলিয়ন ডলার। এর বড় অংশই পরিবহন, যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক করিডোর উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের উত্তেজনা:
২০২৩ সালের আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানের পর শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং সাম্প্রতিক কূটনৈতিক উত্তেজনা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় তৈরি করেছে। বিশেষ করে, আগরতলায় বাংলাদেশি সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সম্পর্কের সামঞ্জস্য না থাকলে এসব প্রকল্পের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, "দুই দেশের সম্পর্ক ভারসাম্যপূর্ণ না হলে কানেক্টিভিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে যায়।"
জাইকা ও এডিবির প্রকল্পের বিশদ বিবরণ
জাইকা উত্তর-পূর্ব ভারতে সড়ক ও সেতু নির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। আসামের ধুবড়ি থেকে মেঘালয়ের ফুলবাড়ী পর্যন্ত নির্মাণাধীন ১৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি, যা ভারতের দীর্ঘতম সেতু হতে যাচ্ছে, এর একটি বড় উদাহরণ। এটি বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ সহজ করবে। ২০৩০ সালের মধ্যে এ সেতু দিয়ে বছরে ১ কোটি ১৮ লাখ টন পণ্য পরিবহন এবং ৩০ লাখ যাত্রী চলাচল করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মেঘালয়ের তুরা থেকে ডালু এবং শিলং থেকে ডাউকি পর্যন্ত মহাসড়ক উন্নয়নেও জাইকার বিনিয়োগ রয়েছে। এসব প্রকল্প মূলত বাংলাদেশের সঙ্গে কানেক্টিভিটি বাড়ানোর লক্ষ্যেই নেওয়া হয়েছে।
এডিবি, সাসেকের আওতায়, ঢাকা-সিলেট করিডোর এবং ঢাকা-নর্থওয়েস্ট করিডোরের মতো প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন এবং আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যকে আরও সহজ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ভূরাজনৈতিক প্রভাব:
উত্তর-পূর্ব ভারতের আটটি রাজ্যকে (আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, সিকিম, অরুণাচল প্রদেশ এবং মণিপুর) ঘিরে নয়াদিল্লির ‘লুক ইস্ট’ এবং ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতিমালা কানেক্টিভিটি প্রকল্পগুলোর ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান এবং সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ এই প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি ত্বরান্বিত করেছিল।
ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়:
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত না হয়, তবে প্রকল্পগুলোর লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হয়ে পড়বে। আন্তর্জাতিক কূটনীতির এক পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেন, "ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে বড় প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার আগে বাংলাদেশকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।"
এডিবি এবং জাইকা, উভয় সংস্থা, এ প্রকল্পগুলো নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবে তা এখনও অনিশ্চিত। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের উদ্বেগ যথেষ্ট যৌক্তিক।
0 Comments